এমসি কলেজে গৃহবধূকে ধর্ষণ: ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য আটকে আছে চার্জশিট
দৈনিক মানচিত্র ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ৬:৪০ পূর্বাহ্ণস্টাফ রিপোর্টার
সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজে ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার দুইমাসেও অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে পারেনি পুলিশ। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদনও এখনো এসে পৌছায়নি। পুলিশ বলছে, তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ। ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অভিযোগপত্র প্রদান করা হবে।
ধর্ষণের ঘটনায় হাইকোর্ট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিনটি কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে, ধর্ষণের শিকার তরুণীর শারীরিক ক্ষত সেরে উঠলেও এখন মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি এখন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী (২৫)। করোনার কারণে বন্ধ থাকা ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে ওই রেখে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। এরপর তাদের মারধর করে টাকাপয়সাও ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। ওই রাতেই নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে নগরীর শাহপরান থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। জনমতের চাপ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী আইনও সংশোধন করে সরকার।
এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের তদন্ত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে এখনও ডিএনএ রিপোর্ট আসেনি। ডিএনএ রিপোর্ট হাতে পেলেই অভিযোগপত্র প্রদান করা হবে।
তবে দুই মাসেও এই মামলার অভিযোগপত্র দিতে না পারাকে আইনের লঙ্ঘন উল্লেখ করে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী এসব মামলায় আসামি হাতেনাতে ধরা পড়লে ১৫ দিনের মধ্যে এবং হাতেনাতে ধরা না পড়লে ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। ফলে এই সময়ের মধ্যে ডিএনএ রিপোর্ট চলে আসার কথা।
তিনি বলেন, এধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় ডিএনএ রিপোর্ট আসতে এতোটা বিলম্ব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও এসব ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিলো।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে নববিবাহিত স্ত্রীকে প্রাইভেটকারে করে শাহপরান মাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন নগরের দক্ষিণ সুরমার জৈনপুর এলাকার এক যুবক। ফেরার পথে সন্ধ্যার দিকে টিলাগড়ে এমসি কলেজের মূল ফটকের সামনে থামেন তারা। এসময় কয়েকজন তরুণ এসে ওই যুবকের স্ত্রীকে ঘিরে ধরেন। একপর্যায়ে প্রাইভেটকারসহ ওই যুবককে সস্ত্রীক বালুচরে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে যান তরুণরা। এরপর যুবককে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে প্রাইভেটকারের মধ্যেই ধর্ষণ করেন ৫/৬ জন। পরে এই দম্পতিকে মারধর করে তাদের কাছে থাকা টাকাপয়সা, স্বর্ণালাকার ছিনিয়ে নেন ধর্ষকরা। আটকে রাখেন প্রাইভেটকারও। ছাত্রাবাস থেকে ছাড়া পেয়ে টিলাগড় পয়েন্টে এসে পুলিশকে ফোন করেন নির্যাতিতার স্বামী। পরে পুলিশ গিয়ে ছাত্রাবাস থেকে ওই দম্পতির প্রাইভেটকার উদ্ধার করে এবং নির্যাতিতা তরুণীকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করে। তবে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান অভিযুক্তরা।
ওই রাতেই ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জনকে আসামি করে শাহপরান থানায় মামলা দায়ের করেন নির্যাতিতার স্বামী। আর সোয়াশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। দায়ীদের বিচার ও নারী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ।
মামলা দায়েরের পর আসামিরা পালিয়ে গেলেও ঘটনার ৩ দিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম এবং সন্দেহভাজন আসামি মিসবাউর রহমান রাজন ও আইনুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোনো পদে না থাকলেও গ্রেপ্তার হওয়া সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত বলে স্থানীয় ও কলেজ সূত্রে জানা যায়।
গ্রেপ্তারের পর তাদের প্রত্যেককে ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে সকলেই ধর্ষণের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
এদিকে, ধর্ষণের রাতে এমসি কলেজে ছাত্রবাসে সাইফুর রহমানের দখলে থাকা কক্ষে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সাইফুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে। সেই মামলার অভিযোগপত্রও এখনও দেওয়া হয়নি।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের মঙ্গলবার বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট আদালতে এসে গেছে বলে আজ জানতে পেরেছি। আশা করছি শীঘ্রই আমাদের হাতে এসে পৌছে যাবে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই অভিযোগপত্র প্রদান করা হবে।
কবে নাগাদ অভিযোগপত্র প্রদান করা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোনো তারিখ বলা যাবে না। তবে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই প্রদান করবো। এই মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অনেক উপরমহল থেকেও এটি তদারকি করা হচ্ছে। ফলে এখানে সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই।
প্রকাশিত হয়নি একটি তদন্ত প্রতিবেদনও : ধর্ষণের ঘটনার পর হাইকোর্ট থেকে সিলেটের জেলা ও দায়রা জজকে প্রধান করে ২৯ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৬ অক্টোবর এই কমিটি ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মহি উদ্দিন শামিমের বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়। শুনানি শেষে ২০ অক্টোবর প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এছাড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৬ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের এই কমিটি ১০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয়।
২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) মো. শাহেদুল খবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। ১ অক্টোবর এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. গোলাম রাব্বানীকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাঁচ কার্যদিবস পর এই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
চারটি তদন্ত কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।
তবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১২ অক্টোবর ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া ৪ জনের ছাত্রত্ব বাতিল করে জাতীয় বিবিদ্যালয়।
ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া চার শিক্ষার্থী হলেন- বিএসএস ডিগ্রি পাস কোর্সের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের অনিয়মিত ছাত্র সাইফুর রহমান (২৮), ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি মাস্টার্স ফাইনালবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি (২৫), বিএসএস ডিগ্রি পাস কোর্সের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম (২৫) এবং ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্স ফাইনালবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান (২৫)।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা প্রসঙ্গে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সালেহ আহমদ বলেন, পুলিশ এই ঘটনায় তদন্ত করছে। বিচারবিভাগের নির্দেশেও আলাদা তদন্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এগুলো প্রভাব ফেলতে পারে। তাই তদন্ত প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখা হয়েছে। পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করার পর তা প্রকাশ করা হবে।
কেমন আছেন নির্যাতিতা তরুণী : ধর্ষণের পর পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলো নির্যাতিতা তরুণীকে। সেখারেন তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যান তিনি। শারীরিক ক্ষত সারলেও মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত এখনো, তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি বলে জানিয়েছেন নির্যাতিতার স্বামী।
নির্যাতিতার স্বামী ও এই মামলার বাদী মঙ্গলবার বলেন, আমার স্ত্রী এখনও তার বাবার বাড়িতে আছেন। তিনি মানসিকভাবে এখনও বিধ্বস্ত রয়েছেন।
অভিযোগপত্র প্রদানের ব্যাপারে তিনি বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুতিনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে তা জানাননি।
সবুজ সিলেট/নভেম্বর ২৫/ সেলিম হাসান