সব চূড়ান্ত, কেবল ভ্যাকসিন পাওয়ার অপেক্ষা
দৈনিক মানচিত্র ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণসবুজ সিলেট ডেস্ক::
আগামী জানুয়ারি মাসে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসবে বলে আশা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনা। সেটা চলে গেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে। দেশেও এ সংক্রান্ত সব কাজ শেষ হয়েছে। এখন কেবল ভ্যাকসিন পাওয়ার অপেক্ষা। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার এই ভ্যাকসিনের দুটি করে ডোজ পাবেন একজন মানুষ। প্রথম ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে গত ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়।
সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে তিন কোটি ভ্যাকসিন পাবে। এজন্য সরকারের ব্যয় হবে এক হাজার পাঁচশ’ উননব্বই কোটি তেতাল্লিশ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভ্যাকসিন কেনা থেকে শুরু করে মানুষের শরীরে দেওয়া পর্যন্ত এই টাকা প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় অর্ধেক পরিমাণ প্রায় ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছাড় করেছে। তবে এই ভ্যাকসিন অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রিকোয়ালিফায়েড হতে হবে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকতে হবে। জনগণের সেফটির (নিরাপত্তা) কথা চিন্তা করে সবকিছু করা হবে।
গত ২২ নভেম্বর কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি তাদের ২২তম সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস চুক্তির এবং অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্তকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে মতামত দিয়ে বলেছে, প্ল্যানটি সম্পূর্ণ ও যথাযথ। একইসঙ্গে সভায় মতামত দেওয়া হয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্যাকসিন বিতরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আর এই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ‘পারচেজ এগ্রিমেন্ট’ করতে হবে, সে অনুযায়ী ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে সেরাম ইনস্টিটিউটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া, তারপর ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয় রয়েছে। ব্যাংক গ্যারান্টির পর তিন কোটি ভ্যাকসিনের জন্য অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করা হবে। বাকিটা দেওয়া হবে ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে বাংলাদেশে আসার পর।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার পর জানুয়ারি মাসের কোনও এক সময় দেশে ভ্যাকসিন আনা যাবে, সব অনুমোদন হয়ে যাওয়ার পর।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তবে সেরাম ইনস্টিটিউট অনুমোদন পেয়ে যাবে বলে আমাদের জানিয়েছে। অনুমোদন পেলেই আমাদের তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে নিয়ে আসবো এবং এই ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা হয়েছে, রাখার ব্যবস্থা হয়েছে এবং ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য যে জনবল, তার প্রশিক্ষণ চলছে। একইসঙ্গে, স্থানীয়ভাবে যেসব বিষয়ের প্রয়োজন হবে, সেসবেরও ব্যবস্থা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং সেসবও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি আমাদের সকল প্রস্তুতি এর মধ্যে সম্পন্ন করে ফেলতে পারবো।’
তবে তিন কোটি ডোজ একবারে আসবে না জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আসবে ছয় মাসে। অর্থাৎ প্রতিমাসে আমাদের ৫০ লাখ ডোজ দেবে তারা। আর সেই ৫০ লাখ ডোজ আমরা ২৫ লাখ মানুষকে দিতে পারবো।’
তবে কেবল তিন কোটি ডোজই না, আমাদের আরও বেশি ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে জানালে তিনি বলেন, ‘যদি তারা দিতে পারে, তাহলে এটাই অব্যাহত রাখা হবে। আর যদি তারা না দিতে পারে, তাহলে যে ভ্যাকসিন ভালো প্রমাণিত হবে সেটাই আনা হবে।’
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘রাশিয়া, সেনোফি, ফাইজার, ভারতের বায়োটেক, সিনোভ্যাক—সবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। যোগাযোগের কোনও ঘাটতি নেই আমাদের। তবে যেটা সুলভে পাবো এবং যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে না, সেই ভ্যাকসিনই আমরা আনবো।’
প্রথমেই কারা পাচ্ছেন ভ্যাকসিন
ভ্যাকসিন বিষয়ক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মা, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায়। কাদের কাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলে ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনাতে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, ‘এটা সংখ্যাভিত্তিক নয়, আনুমানিক হারে ধরা হয়েছে। আর এজন্য সরকার জাতীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করে দেবে।’
তিনি জানান জাতীয় পরিকল্পনাতে ভ্যাকসিন দেওয়ার তালিকাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীকে প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আনুমানিক হারে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন দুই লাখ ১০ হাজার, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তিন লাখ, বেসরকারি কর্মী রয়েছেন সাত লাখ, স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন এনজিও কর্মী রয়েছেন আরও দেড় লাখ। গণমাধ্যম কর্মী রয়েছেন ৫০ হাজার; এছাড়া জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ হাজার ব্যক্তি।
ড. শামসুল হক বলেন, ‘মোট পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রায় ৫ লাখের ওপরে, তবে তাদের সবাইকে ধরতে পারছি না। আমরা বলেছি, ট্রাফিক পুলিশে যারা কাজ করেন তাদের আগে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে।’
তবে ষাটোর্ধ্বদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আবার প্রাধান্য পাবে ক্যানসার, যক্ষ্মা আর ডায়াবেটিকে আক্রান্ত রোগীরা। এমন রোগীদের ধরা হয়েছে এক লাখ দুই হাজারের মতো। আর সেনাবাহিনী জন্য ধরা হয়েছে তিন লাখ এবং সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধি ধরা হয়েছে ৭০ হাজার।’
অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিনের পার ডোজে কত খরচ পড়বে জানতে চাইলে ডা. শামসুল হক বলেন, ‘উৎপাদন থেকে পরিবহনসহ আনার খরচ পড়বে প্রতি ডোজে পাঁচ ডলার করে। তবে এখানে আসার পর এক দশমিক ২৫ ডলার করে যোগ হবে, এটাই হবে ভ্যাকসিনের খরচ।’
আর ইপিআইয়ের ২৬ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী এই কার্যক্রম চালিয়ে নেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন রাখার জন্য ৬৪ জেলায় কোল্ডচেইন নিয়ে কাজ হচ্ছে। হাম ও রুবেলা টিকা দেওয়া হয়ে গেলেই ভ্যাকসিন রাখার স্টোরেজ খালি হয়ে যাবে, ইতোমধ্যে ফাঁকা হওয়া শুরু করেছে, আগামী ১৫ দিন পর সব ফাঁকা হয়ে যাবে।’
‘তবে এই ভ্যাকসিনের জন্য ধৈর্য ধরতে হবে, কেউ যেন অস্থির না হন সেই অনুরোধ করছি’, বলেন ডা. শামুসল হক।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত
ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির চেয়ার ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ”ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এটা যেহেতু ‘লাইভ আইটেম’ তাই কিছু কিছু পরিবর্তন হয়তো সব সময়ই হতে থাকবে, কিন্তু পরিকল্পনা চূড়ান্ত।”
পরিকল্পনাতে কী কী রাখা হয়েছে জানতে চাইলে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ভ্যাকসিন কীভাবে-কাদের দেওয়া হবে, প্ল্যানিং কোঅর্ডিনেশন কীভাবে হবে, জেলা পর্যায়ের কমিটিতে কারা থাকবে, কারা কাজ করবে, প্রায়োরিটি গ্রুপ কারা, ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় সার্ভিস ডেলিভারি কীভাবে হবে, ভ্যাকসিন ডেলিভারির সঙ্গে সম্পর্কিত লজিস্টিক, কোল্ড চেইন মেইনটেইন, কমিউনিকেশন, সার্ভিলেন্স, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় সেক্ষেত্রে কী করতে হবে, মনিটরিং কীভাবে হবে—এসব কিছু রয়েছে সেখানে।’
অপরদিকে টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট-জিএভিআই বা গ্যাভির কাছে বাংলাদেশ গ্যাভি-কোভ্যাক্স সুবিধা থেকে ৮ মিলিয়ন বা ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন পাবে জানিয়ে ডা. শামসুল হক বলেন, ‘আমাদের আবেদন তারা অ্যাক্সেপ্ট করেছে, আমরা গ্যাভি থেকে ভ্যাকসিন পাচ্ছি, প্রতিজন দুই ডোজ করে পাবে। মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ শতাংশ হারে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ এই ভ্যাকসিন পাবে।’
সবুজ সিলেট/১৪ ডিসেম্বর/শামছুন নাহার রিমু