অর্থনৈতিক স্বস্তিতে সরকার
দৈনিক মানচিত্র ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:৩৭ অপরাহ্ণসবুুজ সিলেট ডেস্ক ::
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হচ্ছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও আর্থিক দিক থেকে অনেকটা হেসে-খেলেই এই সময় পার করছে সরকার। যদিও করোনা মহামারিকালে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। জুন মাসে যখন বাজেট ঘোষণা করা হয়, তখন পৃথিবীর বড় বড় দেশ অর্থনৈতিক সংকটে ঘোর অন্ধকার দেখছিল। এমন সংকটের সময়েও সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশের বেশি নির্ধারণ করে। তবে ওই সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থ সংস্থানের। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে অর্থের জোগান নিয়ে তেমন কোনও চাপে পড়তে হয়নি। আর কয়েকদিন গেলেই অর্থবছরের ছয় মাস পার হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রান্তিকও সরকার হেসেখেলেই পার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের তথ্য বলছে, অর্থনীতির বিবেচনায় স্বাচ্ছন্দ্যেই রয়েছে সরকার। যদিও জুনে যখন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়, তখন দেশের অর্থনীতি ছিল প্রায় স্থবির। করোনার কারণে মার্চ থেকে টানা তিন মাস দেশের মানুষ ছিল প্রায় গৃহবন্দি। তারপরও এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পরিসংখ্যান বলছে, বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের কোনও সংকট নেই সরকারের। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রথম প্রান্তিকে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আয়ে ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শুল্ক, মূসক, আয়কর ও অন্যান্য উৎস থেকে রাজস্ব আয় অল্প হলেও বেড়েছে।
এদিকে সরকারের আর্থিক অবস্থা যে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও—তা প্রমাণ করে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা দেখে। আগের চেয়ে একদিকে ব্যাংক ঋণ কমেছে, অপরদিকে করোনাকালেও বাড়ছে সরকারের রাজস্ব আয়। আবার মুদ্রাবাজারে অলস তারল্যের জোয়ার সরকারের সুদ ব্যয়ও অনেক কমিয়ে এনেছে। সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ফিরেছে রেকর্ড উদ্বৃত্তের ধারা। রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে বেড়েই চলেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সব মিলিয়ে মহামারির দুঃসময়েও অর্থের সংস্থান ও উৎস নিয়ে সরকার যেকোনও সময়ের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার অর্থের সংস্থানের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যায় পড়েনি। সামষ্টিক অর্থনীতি স্বস্তিতেই আছে। মূল্যস্ফীতি কিছু বাড়লেও কোনও সমস্যা হচ্ছে না। তবে করোনার দ্বিতীয় ধাপে দেশের অভ্যন্তরে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। আর যদি লকডাউনের মতো পরিস্থিতির তৈরি না হয়, আর বিনিয়োগ যদি বাড়ানো যায়, সেক্ষেত্রে সরকারের জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা, তা পূরণ হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, মহামারি করোনাকালে যেখানে ভারতসহ বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশে কোনও প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশ ৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করছে। অর্থবছর শেষে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘করোনাকালে আমরা সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে এনে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছি। তার সুফল এটা।’ তিনি বলেন, ‘মহামারির মাঝে অর্থের উৎসগুলো ঠিক রাখা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছি।’ তিনি উল্লেখ করেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি চাঙা রাখার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটা জনগণের মধ্যে আস্থা ফেরাতে সহায়তা করেছে। তার মতে, এরইমধ্যে দেশের বেসরকারি খাতও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের শতভাগ বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি খাতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। তাতে, ৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধির আশাও পূরণ হবে।
অবশ্য বাংলাদেশ ছাড়া ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা পৃথিবীর আর কোনও দেশই করছে না বলে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া এই বছরে পৃথিবীর কোনও দেশই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।’
প্রসঙ্গত, এর আগে টানা তিন মাস লকডাউনের কারণে সবকিছু বন্ধ থাকার পরও গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৫০ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাত থেকে ২৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা ঋণ নিতে হয়েছিল সরকারকে। অথচ চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎস মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে এই তিন উৎস থেকে সরকারকে মোট ঋণ নিতে হয়েছিল ৩৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নিট ১১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। যদিও সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিল-বন্ডের সর্বনিম্ন সুদহার ছিল ৭ শতাংশের বেশি। অথচ চলতি ডিসেম্বরে সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ সরকারের সুদ ব্যয়ও কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে সৃষ্টি হয়েছে রেকর্ড ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য। ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকা অলস তারল্যের সুফল পাচ্ছে সরকার। এতে সরকারের সুদ ব্যয় অর্ধেকেরও অনেক নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৭১ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫৩ কোটি ডলার। একইসঙ্গে সরকারের ব্যালান্স অব পেমেন্টেও (বিওপি) রেকর্ড উদ্বৃত্ত অর্থ জমা হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিওপিতে ২০ কোটি ডলার ঘাটতি থাকলেও চলতি বছরের একই সময়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ কোটি ডলার।
এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি উৎস থেকে সরকার ঋণ পেয়েছিল ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরে সরকার বিদেশি উৎস থেকে ৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এই বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব খাত থেকে আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের বাকি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সরকার। বাকি অর্থ সঞ্চয়পত্রসহ অভ্যন্তরীণ অন্য উৎস এবং বিদেশি উৎস থেকে সংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
সবুজ সিলেট / এস মায়াজ আহমদ তালহা